চীনের হুবে প্রদেশের উহান শহরের ভাইরোলজি ল্যাব থেকে কোভিড ছড়িয়েছিল বলে একটি তত্ত্ব আছে।
ভাইরাস বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও বিভক্তি
বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে ষড়যন্ত্র-তাত্ত্বিক – সব পক্ষ থেকেই করোনাভাইরাসের উদ্ভব নিয়ে নানা সময় নানারকমের তত্ত্ব দেয়া হয়েছে।
কিছু জরিপে আভাস দেয়া হয় যে, চীনের উহান শহরের একটি বাজার – যেখানে বন্যপ্রাণী এবং সামুদ্রিক খাবার বিক্রি হতো – সেখানেই কোন প্রাণী থেকে সম্ভবত ভাইরাসটি মানুষের দেহে ঢুকে পড়েছিল।
আরেকটি তত্ত্ব হচ্ছে যাকে বলা যায় “প্রাকৃতিক উৎস তত্ত্ব”। এর মূল কথা হলো এই করোনাভাইরাসটি কোন কোন প্রাণীর মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই ছড়িয়েছিল।
এর সমর্থকরা বলেন, সার্স-কোভ-টু (পরবর্তীকালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া নাম) ভাইরাসটি প্রথম দেখা দেয় বাদুড়ের দেহে, এবং তার পর তা মানুষের দেহে ঢুকে পড়ে – সম্ভবত অন্য কোন একটি প্রাণীর মাধ্যমে, যাকে বলা হয় ‘ইন্টারমিডিয়ারি হোস্ট।‘
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সহ অনেক প্রতিষ্ঠান ও বিজ্ঞানী এ তত্ত্বকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু পরে দেখা যায় যে বাদুড় বা অন্য কোন প্রাণীর দেহে এমন কোন ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না – যার সাথে কোভিড-১৯এর মিল আছে।
তখন এ তত্ত্ব নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়।
চীনা কর্তৃপক্ষ নিজেরা করোনাভাইরাস সম্পর্কে বলছে যে - দক্ষিণপূর্ব এশিয়া বা চীনের অন্যত্র থেকে উহানে যে হিমায়িত মাংসের চালান আসছিল, তার মাধ্যমেও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে থাকতে পারে।
আরেকটি গবেষণার দিকেও অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিল চীনা সরকার।
সেটি হচ্ছে উহান ইনস্টিটিউটের নেতৃস্থানীয় একজন ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শি ঝেংলির একটি গবেষণা, যা ২০২১ সালে প্রকাশ করা হয়।
ওই গবেষণায় বলা হয়, তারা ২০১৫ সালে একটি খনিতে বাসা-বাঁধা বাদুড়ের দেহে আট ধরনের করোনাভাইরাস চিহ্নিত করেছিলেন। তবে তার মতে এগুলোর চাইতে প্যাঙ্গোলিন বা বনরুই থেকে আসা ভাইরাস মানুষের জন্য অধিকতর হুমকি হতে পারে।
চীনা প্রচারণাকারীরা আরেকটি তত্ত্বও ছড়িয়েছিল, যার পক্ষে কোন প্রমাণ নেই। এর বক্তব্য – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির ৫০ মাইল দূরের ফোর্ট ডেরিক নামে মার্কিন জীবাণু অস্ত্র কর্মসূচির কেন্দ্র থেকেই করোনাভাইরাস তৈরি করা এবং ছড়ানো হয়েছে।
ল্যাব-লিক তত্ত্বকে কি 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব'?
ল্যাব-লিক তত্ত্বকে এক সময় একটা প্রায় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবেই দেখা হতো। তবে নানা সময় বিশেষজ্ঞরা এরকম সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিলেও তা জল্পনা হিসেবে সব সময়ই রয়ে গেছে।
কী বলা হচ্ছে 'ল্যাব-লিক' তত্ত্বে?
এই তত্ত্বের মূল কথা হলো – মধ্য চীনের উহান শহরের একটি ল্যাবরেটরি থেকে করোনাভাইরাস কোনভাবে বাইরে বেরিয়ে পড়েছিল। সেটা অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনাবশতঃ ঘটে থাকতে পারে বা অন্য কিছুও হতে পারে।
এ তত্ত্বের যারা সমর্থক তারা এ জন্য অঙ্গুলি নির্দেশ করছেন উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির দিকে।
এটি ভাইরাসসংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্বের একটি নেতৃস্থানীয় প্রতিষ্ঠান।
এতে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাদুড়ের দেহে থাকা করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছিল।
উহান শহরের যে বাজারটি থেকে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়েছিল – তা থেকে ওই ইনস্টিটিউটে গাড়িতে যেতে ৪০ মিনিট সময় লাগে।
এই তত্ত্বের সমর্থকরা বলছেন, সম্ভবত উহান ইনস্টিটিউট থেকে ভাইরাসটি কোন উপায়ে বাইরে চলে যায় এবং ওই বাজারটিতে অনেকের দেহে সংক্রমিত হয়। বেশির ভাগই মনে করেন যে এটি সম্ভবতঃ জঙ্গল থেকে সংগৃহীত কোন ভাইরাস ছিল - যাতে কোন পরিবর্তন ঘটানো হয়নি।
মহামারির একেবারে শুরুর দিকে এই বিতর্কিত তত্ত্ব ছড়িয়েছিল এবং তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এর বিস্তারে হাওয়া দিয়েছিলেন।
তখন এমন কথাও কেউ কেউ বলেছিলেন যে সম্ভাব্য জীবাণু অস্ত্র হিসেবে ভাইরাসটি তৈরি করা হচ্ছিল।
একটি 'অতিগোপনীয়' মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্ট - যা ২০২১ সালে মার্কিন সংবাদ মাধ্যমে বেরিয়েছিল, তাতে বলা হয়, উহান শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ঠিক আগে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির তিন জন গবেষক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
তাদেরকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল। আক্রান্তদের লক্ষণের সাথে কোভিড-১৯এর উপসর্গ এবং সাধারণ ফ্লু - দুটিরই মিল আছে বলে সরকারি তথ্যে বলা হয়, তাই এই দাবির প্রকৃত প্রাসঙ্গিকতা কী তা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব ছিল না।
তা ছাড়া এ তথ্যের উৎস কী - তাও জানানো হয়নি।
ভাইরাসের গবেষণা কত বিপজ্জনক?
বিভিন্ন দেশে যেসব ল্যাবরেটরিতে ভাইরাস নিয়ে গবেষণা হয় - সেখানে অতি উচ্চ মাত্রার সতর্কতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে।
এর কারণ - এধরনের গবেষণার কাজে কোন ত্রুটি ঘটলে তা চরম বিপদ ঘটাতে পারে।
এ নিয়ে কথা হয় যুক্তরাজ্যের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকিউলার ভাইরোলজির অধ্যাপক জোনাথন বলের সাথে।
তিনি জানান, যেসব গবেষণাগারে মার্স বা সার্স ভাইরাসের মত বিপজ্জনক করোনাভাইরাস নিয়ে কাজ হয়, সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই "লেভেল থ্রি বায়োসিকিউরিটি" স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়।
"এর আওতায় গবেষকরা বহু ধরনের যন্ত্রপাতি, নিরাপদ ক্যাবিনেট, সুরক্ষিত পোশাক এবং অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করেন। শ্বাসতন্ত্রের ভাইরাস গবেষণার ক্ষেত্রে তাদের আবশ্যিকভাবে স্বতন্ত্র শ্বাস নেবার যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়। কর্মীদের কাপড়চোপড় ও সকল রকম বর্জ্য বিশেষ ব্যবস্থায় দূষণমুক্ত করা হয়।"
অধ্যাপক জোনাথন বলের কথায়, কোন ভাইরাস নিয়ে কাজ করার সময় সব 'স্যাম্পল' নিরাপদ কনটেইনার বা ক্যাবিনেটে রাখা নিশ্চিত করা হয় যাতে তা বাইরে বেরুতে না পারে, বা দুর্ঘটনাবশতঃ কেউ তার সংস্পর্শে না আসে।
"এজন্য 'নেগেটিভ প্রেশার রুম' নামে বিশেষ ধরনের কক্ষ ব্যবহৃত হয় - যা থেকে দুষিত বাতাস বাইরে বেরোতে পারে না।"
ল্যাবরেটরিতে এ ধরনের গবেষণার সময় দুর্ঘটনার কথা যে আগে কখনো শোনা যায়নি তা নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ২০২২ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে যে চীনের বেজিংএ একটি ল্যাবরেটরিতে অন্তত দুবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা লংঘনের কারণে ৯ জন লোক সার্স ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, তার মধ্যে একজন মারা যায়।
তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুরেও এরকম দুটি ঘটনার কথা রিপোর্টটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
তত্ত্বের পেছনে রাজনীতি?
জন সাডওয়ার্থ বলছেন, এফবিআইয়ের পরিচালক এমন এক সময় এই 'ল্যাব লিক' তত্ত্বের প্রতি সমর্থন জানালেন যে বিজ্ঞানীদের একটি অংশের সন্দেহ হচ্ছে - এর পেছনে রাজনীতি কাজ করছে কীনা।
0 Comments